দ্য লাস্ট কারাভেল পর্ব-৩

হারানো ছায়ার সংকেত

লুকাস দাঁড়িয়ে ছিল ভাঙ্গা কাঠের স্তূপের মাঝে।
তার হাতে সেই অদ্ভুত ধাতব পিন, আর চোখের সামনে সমুদ্রের গভীর দিক থেকে আসা এক রহস্যময় নীল আলো। বৃদ্ধ ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এলেন। তার মুখ ছিল ছায়ায় ঢাকা, কিন্তু গলার স্বর ছিল কাঁপা, কঠিন। “তুমি এটা পেয়েছো… তবে এটা কেবল শুরু,” বললেন তিনি। “সত্যিকারের যাত্রা এখন শুরু হবে, লুকাস। এখন সিদ্ধান্ত তোমার।”

লুকাস পিনটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরল। সে জানত, এই মুহূর্তে তার সামনে দুটো পথ — হয় ফিরে যাওয়া, নাকি অজানার দিকে পা বাড়ানো। বৃদ্ধ পকেট থেকে বের করলেন একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স।

চাপা সুরে বললেন, “তোমার বাবার শেষ চিঠি এটা। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন, ঠিক এই মুহূর্তের জন্য।” লুকাস বাক্সটা খুলল। ভেতরে ছিল একটা হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজের খণ্ড আর একটা ছোট চামড়ার টুকরা। চামড়ার টুকরোয় আঁকা ছিল সমুদ্রের উপর ভেসে থাকা তিনটি দ্বীপের অবয়ব, আর নিচে লেখা —

“তিন ছায়া যেখানে মিলে যায়, সেখানে ঘুমায় সত্য।”

চিঠির অক্ষরগুলো কাঁপা হাতে লেখা, কিন্তু শব্দগুলো তীব্র এবং দৃঢ়:

“লুকাস, যদি কখনো এই পথ বেছে নাও, মনে রেখো —
তোমাকে ভয় করবে, তোমাকে বিভ্রান্ত করবে, কিন্তু সত্যের আলো কখনো নিভে না।
আমি তোমাকে ভালোবাসি। খুঁজে বের করো — শেষ সত্য।”

চিঠি পড়তে পড়তে লুকাসের চোখের কোণে জল জমে উঠলো। সে কখনো বাবাকে কাছ থেকে জানত না — শুধু গল্প, ফিসফিসে কথায় তৈরি করা একটা রহস্যময় চরিত্র ছিল তার মনে। আজ সে বুঝতে পারলো — বাবা তাকে সবসময় রক্ষা করছিলেন দূর থেকে। লুকাস পকেট থেকে বাবার মানচিত্র বের করলো। মানচিত্র দেখে সে বুঝলো, মানচিত্রে যে তিনটা দ্বীপ আঁকা — সেগুলো একটা নির্দিষ্ট বিন্যাসে আছে। যদি সে সঠিক পথে এগোয়, তবে হয়তো হারানো কারাভেল আর বাবার শেষ সত্য খুঁজে পেতে পারবে।

“তিন ছায়া…” লুকাস ফিসফিস করলো।
“এর মানে কী?”

বৃদ্ধ বললেন, “তিনটি দ্বীপের ছায়া যখন নির্দিষ্ট সময়, নির্দিষ্ট কোণে পড়ে, তখন একটিমাত্র বিন্দুতে মিলে যায়।
তোমাকে সেই বিন্দু খুঁজে পেতে হবে। তবে খেয়াল রেখো — পথটা সহজ হবে না।”

সমুদ্রের ওপরে বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠলো।
দূর থেকে মেঘের গর্জন ভেসে আসছিল — অচিরেই ঝড় উঠবে। “আমাদের আজ রাতের মধ্যেই রওনা হতে হবে,” বললেন বৃদ্ধ। “ঝড় নামার আগে না বেরোতে পারলে, হয়তো আর কখনো পারবো না।” লুকাস তার হাতের পিন, মানচিত্র আর বাবার চিঠি শক্ত করে ব্যাগে গুঁজে নিল।

তার মনে হচ্ছিল, সমুদ্রের গভীরে কোনো কিছু তাকে ডাকছে — হয়তো সত্য, হয়তো অনন্ত বিপদ।

ছোট্ট নৌকায় উঠে তারা দ্রুত চলতে শুরু করলো।
পানির ঢেউ ছিল অশান্ত, আকাশের মেঘ ঘন হয়ে আসছিল। বৃদ্ধ নৌকা চালাচ্ছিলেন দক্ষ হাতে, আর লুকাস মানচিত্রের উপর ঝুঁকে তিন দ্বীপের অবস্থান মিলানোর চেষ্টা করছিল। হঠাৎ, সমুদ্রের গভীরে একটা অদ্ভুত শব্দ ভেসে এলো।

কেমন একটা গোঙানির মতো — যেন হারিয়ে যাওয়া কোনো আত্মার করুণ আর্তনাদ।
লুকাস কাঁপা গলায় বললো,
“আপনি শুনেছেন?”

বৃদ্ধ কোনো উত্তর দিলেন না। তার মুখে কঠিন ভাব — তিনি জানতেন, এ ধরনের সংকেত উপেক্ষা করা উচিত।

নৌকার সামনে এবার আবছা দেখা গেল প্রথম দ্বীপের অবয়ব। দূর থেকে মনে হচ্ছিল, যেন তিনটি কালো ছায়া একে অপরের দিকে হাত বাড়িয়েছে। সমুদ্রের পানির মধ্যে ভাসছিল ভাঙ্গা গাছের গুঁড়ি আর অদ্ভুত ধরনের শেওলা। ঠিক তখনই, নৌকার নিচে কিছুর নড়াচড়া অনুভব করলো লুকাস। পানির নিচ থেকে যেন কেউ টানছে নৌকাটাকে! সে চিৎকার করে বললো, “নিচে কিছু আছে!”

বৃদ্ধ চোখ বড় বড় করে বললেন,
“ধরো! কিছুতেই হাত ছাড়বে না!”

নৌকা একটানে কাত হয়ে গেলো। লুকাস সামলে নিতে চাইল, কিন্তু ভারসাম্য হারিয়ে জলের দিকে পড়ে যেতে লাগলো। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সমুদ্রের গাঢ় নীল গভীরতা, আর সেই পুরনো কণ্ঠস্বর —

“ফিরে এসো, লুকাস… এখনো সময় আছে…”

কিন্তু তার মন বললো,
“ভয় পেয়ো না। সামনে যাও।”

এক ঝটকায় সে নিজেকে সামলে নিল। নৌকার দড়ি আঁকড়ে ধরলো প্রাণপণে। তার চোখে তখন শুধু একটাই দৃশ্য — সেই তিনটি ছায়া মিলে গেছে, আর মাঝখানে গাঢ় অন্ধকারে ডুবে থাকা কোনো অজানা দ্বীপ… যেখানে লুকিয়ে আছে হারানো সত্য।

[চলবে…]

পর্ব ১: দ্য লাস্ট কারাভেল

পর্ব ৪: ছায়ার দ্বীপের গহীনে

Leave a Comment