যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ (DOJ) গুগলের সার্চ ইঞ্জিন এবং ব্রাউজার মার্কেটে আধিপত্য রোধে গুরুত্বপূর্ণ আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে। এই পদক্ষেপগুলো প্রযুক্তি ক্ষেত্রের চেহারা পাল্টে দিতে পারে এবং গুগলের দীর্ঘস্থায়ী একচেটিয়া কার্যকলাপকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। এখানে তিনটি মূল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটি বিশদ বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো।
১. গুগলের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং কার্যক্রম
DOJ এবং বেশ কয়েকটি মার্কিন রাজ্য গুগলের একচেটিয়া কার্যক্রম ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে, যার মধ্যে ক্রোম ব্রাউজার বিক্রির নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত। অভিযোগ উঠেছে যে গুগল মার্কিন অ্যান্টিট্রাস্ট আইন লঙ্ঘন করেছে, বিশেষ করে অ্যাপল ও স্যামসাং-এর মতো ডিভাইস নির্মাতাদের সঙ্গে অন্যায্য চুক্তি করে তাদের ডিভাইসে গুগল সার্চকে ডিফল্ট অপশন হিসেবে রাখা হয়েছে।
মূল অভিযোগসমূহ:
- বাজার নিয়ন্ত্রণ: ২০২০ সালে গুগলের মার্কিন অনলাইন সার্চ মার্কেটে ৯০% এবং মোবাইল সার্চে প্রায় ৯৫% শেয়ার দখলে ছিল। এই আধিপত্য প্রতিযোগিতা ও উদ্ভাবনকে বাধাগ্রস্ত করে এবং ভোক্তার পছন্দ সীমিত করে।
- একচেটিয়া চুক্তি: হার্ডওয়্যার নির্মাতাদের সঙ্গে গোপন চুক্তি করে গুগল সার্চকে জনপ্রিয় ডিভাইসগুলোর ডিফল্ট হিসেবে রাখা হয়েছে, যা বিং বা ডাকডাকগো-এর মতো প্রতিযোগীদের বাধাগ্রস্ত করেছে।
- ডেটার অপব্যবহার: ক্রোম ব্রাউজার ব্যবহারকারীর বিশাল পরিমাণ ডেটা সংগ্রহ করে, যা গুগলের বিজ্ঞাপন ব্যবসাকে শক্তিশালী করে এবং তাকে প্রতিযোগিতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে।
DOJ-এর সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে গুগলকে বিশাল জরিমানা গুনতে হতে পারে এবং তার সমন্বিত ইকোসিস্টেম, যেমন ক্রোম, বিজ্ঞাপন এবং এআই মডেলের পৃথকীকরণ, বাধ্যতামূলক হতে পারে।
২. প্রস্তাবিত সমাধান: প্রতিযোগিতার জন্য ভারসাম্য তৈরি
DOJ-এর কাঠামোগত পদক্ষেপগুলো প্রতিযোগীদের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা, ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা রক্ষা করা এবং উদ্ভাবনকে উত্সাহিত করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবিত পদক্ষেপ:
- ক্রোম ব্রাউজার বিক্রি: গুগলকে ক্রোম ব্রাউজার বিক্রি করতে বাধ্য করা হলে মার্কিন বাজারে (৬১%) এবং ইতালিতে (৬৮%) তার বর্তমান আধিপত্য বিপর্যস্ত হবে।
- ডেটা ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা: গুগলের বিভিন্ন সেবায় ব্যবহারকারীর ডেটা সংগ্রহের সক্ষমতা সীমিত করা, যা এআই প্রশিক্ষণ বা লক্ষ্যভিত্তিক বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
- একচেটিয়া চুক্তি নিষিদ্ধ করা: ডিভাইস এ গুগল সার্চকে ডিফল্ট করার চুক্তি নিষিদ্ধ করা।
- ডেটা ভাগাভাগি: উদ্ভাবন ও প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির জন্য গুগলকে তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে সার্চ ডেটা ভাগাভাগি করতে বাধ্য করা।
এই পদক্ষেপগুলো অতীতের মার্কিন অ্যান্টিট্রাস্ট হস্তক্ষেপের প্রতিধ্বনি, যেমন ১৯৯০-এর দশকে মাইক্রোসফটের ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের একচেটিয়া কার্যক্রম ভেঙে দেওয়া। এই ধরনের পদক্ষেপ ক্রোম এবং ফায়ারফক্সের মতো ব্রাউজারকে বাজারে প্রবেশের সুযোগ দিয়েছিল।
৩. প্রযুক্তি শিল্প ও এআই উন্নয়নের উপর প্রভাব
এই অ্যান্টিট্রাস্ট মামলা প্রযুক্তি শিল্পের জন্য, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডিজিটাল বিজ্ঞাপনে, ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।
এআই ও বিজ্ঞাপনে প্রভাব:
- ডেটা প্রাপ্যতা: গুগলের এআই প্রশিক্ষণের জন্য ডেটা অ্যাক্সেস সীমিত করা হলে প্রতিযোগীদের এআই প্রযুক্তি উন্নত করার সুযোগ তৈরি হবে।
- একচেটিয়া কমানো: প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করে বাজারে বৈচিত্র্য আনতে সহায়তা করা।
- প্রকাশকদের আয় বৃদ্ধি: গুগল সার্চের এআই ফিচার বর্তমানে অনলাইন প্রকাশকদের ট্রাফিক কমিয়ে দেয়। অ্যান্টিট্রাস্ট ব্যবস্থা প্রকাশকদের কনটেন্ট ও বিজ্ঞাপনের আয় রক্ষা করতে পারে।
বৈশ্বিক প্রভাব:
আন্তর্জাতিকভাবে একই ধরনের কার্যক্রম লক্ষ্য করা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, চীনে আলিবাবার ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা যা প্রযুক্তি জায়ান্টদের একচেটিয়া কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের একটি বৈশ্বিক প্রবণতা নির্দেশ করে।
গুগলের প্রতিরক্ষা এবং সম্ভাব্য কৌশল
গুগল DOJ-এর প্রস্তাবগুলোকে “উগ্র এজেন্ডা” আখ্যায়িত করে, যা উদ্ভাবন ব্যাহত করে এবং ভোক্তাদের ক্ষতি করে। তারা দাবি করছে যে তাদের সার্চ ইঞ্জিনের জনপ্রিয়তা মানের উপর ভিত্তি করে তৈরী হয়েছে জবরদস্তির কারণে নয়।
কৌশলগত বিবেচনা:
- আপিল ও বিলম্ব: পূর্ববর্তী মামলাগুলোর মতো গুগলের আইনি লড়াই কয়েক বছর ধরে চলতে পারে।
- নেতৃত্বের প্রভাব: ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হলে, বিগ টেক নিয়ে তার মিশ্র অবস্থানের কারণে মামলার ফলাফল প্রভাবিত হতে পারে।
- বাজারে প্রতিক্রিয়া: যদি ক্রোম বিক্রি করা হয়, গুগলের ইকোসিস্টেম দুর্বল হয়ে যেতে পারে, যা তার বিজ্ঞাপন এবং এআই ক্ষমতাগুলোকে প্রভাবিত করবে।
ভবিষ্যতের চিত্র
২০২৫ সালের মধ্যে চূড়ান্ত রায় দেয়া হবে, যা বৈশ্বিকভাবে বিগ টেকের কার্যক্রম পুনর্নির্ধারণ করতে পারে। DOJ সফল হলে এটি একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হবে এবং ডিজিটাল যুগে একচেটিয়া কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য শক্তিশালী নজির স্থাপন করবে।
আইনি লড়াই যত এগিয়ে যাচ্ছে, এর প্রভাব শুধু গুগলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই মামলা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, ন্যায্য প্রতিযোগিতা, ভোক্তাদের পছন্দ এবং নৈতিক ডেটা ব্যবহারের মধ্যে ভারসাম্য আনার বৈশ্বিক প্রচেষ্টার প্রতীক।