সোমালিয়ার জলদস্যু কারা এবং তাদের উত্থান যেভাবে

বিশ্বজুুড়ে নানা জলদস্যুদের কথা শোনা গেলেও, সবচেয়ে আলোচিত গ্রুপের নাম সোমালিয়ান জলদস্যু। সাগরের বুক চিরে থাকা বিশাল ফাঁদ আর নানা অপহরণ ছিনতাই এ সোমালিয়ার জলদস্যুদের নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত মানুষের মুখে মুখে। বিশ্বজুড়ে এই জলদস্যদের নিয়ে আছে নানা মুখরচখক গল্প।মাঝে কিছু সময় আলোচনায় না থাকলেও কয়েক বছর পরপরই আলোচনায় আসে সোমালিয়ান জলদস্যুরা। গত কয়েকদিন আগেই যখন বাংলাদেশী জাহাজ ছিনতাই করে জিম্মি করেছে তেইশ জন নাবিককে তখন আবারো বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে উঠে এসেছে সোমালিয়ান জলদস্যুদের গল্প। কিন্তু সাগরের বুকে কিভাবে উত্থান ঘটেছে এই জলদস্যুদের, ছিনতাই অপহরণ করে কেমন অর্থ মেলে সোমালিয়ান জলদস্যুদের। কাদের ইন্ধনে চলে এইসব নৈরাজ্য, বিশাল ভারত মহাসাগর ও আরব সাগরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে ত্রাসের রাজত্ব চালানো লড়াকু সোমালিয়ান জলদস্যুদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে সাথেই থাকুন।

 

 


বিশ্ব বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে দেশে দেশে গড়ে উঠেছে নানা বন্দর। দুনিয়া জুড়ে পণ্য পরিবহনের যেসব পথ রয়েছে তার মধ্যে ভারত মহাসাগরের পথটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভারত মহাসাগরের সাথে আছে আরব সাগরও। বিশাল সমুদ্রসীমা হওয়ায় এখানে এককভাবে বাণিজ্যিক জাহাজ পাহারা দেয়া বেশ জটিল একটি কাজ তবে মাঝে মাঝে বিভিন্ন দেশের নৌ বাহিনী অভিযান চালালেও কিছুদিন পরপরই দেখা যায় জলদস্যুদের নানা ঘটনা। এর আগে বেশ কয়েক বছর স্তিমিত থাকলেও সম্প্রতি নতুন করে ব্যাপক তৎপরতা দেখা যাচ্ছে সোমালি জলদস্যুদের।


গত ১২ মার্চ বাংলাদেশি একটি জাহাজ ছিনতাই করে ২৩ জন নাবিক কে জিম্মি করেছে এই জলদস্যুরা। লোহিত সাগরে হুথিদের নিয়ে আন্তর্জাতিক বাহিনী গুলো বেশি ব্যস্ত থাকার সুযোগে ভারত মহাসাগরের Gulf of Aden এ তারা আবারও মাথাচাড়া দিচ্ছে বলে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এদিকে ইতালিয়ান ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে ১৯৬০ সালে জন্ম হয় সোমালিয়ার। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসনের উৎখাতের পরে নৈরাজ্যের মধ্যে পড়ে দেশটি। পরের ২ দশকের বেশি সময় যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত সোমালিয়াতে কার্যকর কোন সরকার ছিল না। এ সময়টাতে আফ্রিকার মধ্যে দীর্ঘতম উপকূল সমৃদ্ধ দেশটির জলসীমায় নিরাপত্তায় কোন কোস্টগার্ড বা বাহিনী ছিল না। এতে ওই অঞ্চলে বিদেশী মাছ ধরা নৌযানের উপস্থিতি ক্রমশ বাড়তে থাকে। এতে স্থানীয় জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল ফলে দস্যুবৃত্তির দিকে ঝুকে পড়ে স্থানীয় বাসিন্দারা। তাছাড়া মৎস্য শিকারের চেয়ে দস্যুতা আয়ের পরিমাণও অনেক বেশি।


তবে কয়েক বছর ধরে দৌড়াতে অতিষ্ঠ হয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো এই রুটে তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়ায় এর ফলে ২০১২ সাল নাগাদ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসে দশ্যবৃত্তি। কিন্তু গত কয়েক মাসে সোমালিয়া জলদস্যুদের তৎপরতা বেড়েছে। পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে কাজ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌ বাহিনী তাদের মতে গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে সোমালিয়া উপকূলে অন্তত 14 টি জাহাজ হাইজ্যাক করা হয়েছে এর মধ্যে ইরানের পতাকা বাহি একটি মাছ ধরার নৌকা এবং লাইবেরিয়ার পতাকা বাহি Central Park নামের একটি জাহাজের জেলে ও নাবিকদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। Central Park এর উদ্ধার তৎপরতায় মার্কিন নৌবাহিনী জড়িত ছিল। পরে তারা জানায় এটা স্পষ্টতই দস্যুতা এবং আক্রমণকারীরা সম্ভবত সোমালিয়া ছিল। ডিসেম্বরে MV Ruin নামে মাল্টার পতাকাবাহী একটি জাহাজ হাইজ্যাক করা হয়। এখনো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ হামলাকারীদের হাতে। জিম্মি আছেন ১৭ জন ক্রু।

 

International Maritime Bureau (IMB) এর মতে এটি ছিল ৬ বছরের মধ্যে সোমালিয়ার প্রথম সফল হাইজ্যাকিং। তবে গত জানুয়ারিতে ভারতীয় নৌবাহিনী ব্যাপক অভিযান চালায়। এক সপ্তাহের তিনটি অভিযানে ১৯ জন জিম্মিকে মুক্ত করতে সমর্থ হয় তারা। তাদের মধ্যে ১১ জন ইরানের নাগরিক বাকিরা পাকিস্তানি। ভারতীয় বাহিনীর তরফে জানানো হয় এদের সবাই সোমালি দস্যুদের হাতে বন্দি ছিলেন।

 

ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি রিয়ালিটি চেক টিমের প্রতিবেদন বলছে, শুধু ২০১৮ সালে পূর্ব আফ্রিকান জলসীমায় ১১২ টি নৌ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। যার সর্বশেষ শিকার বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের দিকে যাওয়ার পথে মঙ্গলবার ২৩ জন ক্রু সহ জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয় জলদস্যুরা।


হুথিদের ঠেকাতে গিয়ে অরক্ষিত সোমালিয়া উপকূল দস্যুরা স্বভাবতই সুযোগ সন্ধানী। তারা নিরাপত্তা বাহিনীকে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করে নানাভাবে। এবার পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতিকে কাজে লাগাচ্ছে তারা। এমনটাই জানিয়েছে রয়্যাল ডেনিস ডিফেন্স কলেজের সহযোগি অধ্যাপক ট্রোয়েলস বুরচাল হেনিংসেন তার দাবি ২০০৫ থেকে ২০১২ সালে জলদস্যুতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। তখন আন্তর্জাতিক বাহিনী ওই জলসীমায় টহল জোরদার করে।

 

কিন্তু সম্প্রতি লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী বেশ কিছু জাহাজ আক্রমণ করায় সেদিকে বেশি নজর দিতে হয়েছে পশ্চিমা বাহিনীগুলোকে। সামরিক দিক থেকে দেখলে হুথিদের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের আক্রমণ মোকাবেলা করাটা বেশি জরুরি। তাই ড্রোন ক্ষেপণাস্ত্র সামাল দিতে গিয়ে জলদস্যুদের দিকে নজর দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন পশ্চিমা সামরিক বাহিনী।

 

এছাড়া পূর্ব আফ্রিকার জলসীমায় সেশেলস এবং কোমোরোস এর মতো দেশগুলোর একটি আঞ্চলিক সংস্থা আইওসি। গেল সপ্তাহে এক বিবৃতিতে হাইজ্যাকিং বেড়ে যাওয়ার পেছনে আরও কিছু কারনও উল্লেখ করেছে আইওসি। প্রায় দেড় দশক আগে প্রথম দফায় জেলেরা যে দস্যুতায় জরিয়ে পরেছিল তার অন্যতম কারণ বিদেশি ট্রলার এসে তাদের এলাকায় অবৈধভাবে মাছ ধরত ফলে স্থানীয় জেলেরা জীবিকার তাগিদে ডাকাতিকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য হয়।

 

আইওসি বলছে বর্তমান সোমালি মৎসনীতির কারনে আবারও বিদেশী মাছ ধরা জাহাজের উপস্থিতি বাড়ছে। এতে আবার উপকূলীয় সোমালিয়া জলদস্যুতার পথে পা বাড়াবে এমন সতর্কতা জানিয়েছে সংস্থাটি। সোমালিয়া ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠি আল শাবাব ডাকাতি আর অপহরণে উস্কানি দিচ্ছে এমন প্রসঙ্গও উঠে আসে আইওসির বিবৃতিতে।

 

একটি কথিত সমঝোতার ব্যাপারে শোনা যায়, যার বদৌলতে দস্যুদের সুরক্ষা দেয় জঙ্গিরা বিনিময়ে আদায়কৃত মুক্তিপণের একটা ভাগ তারা পায়। মূলত ত্রিকোন আকৃতির ভৌগলিক মানচিত্রের কারণে পূর্ব আফ্রিকাকে বলা হয় হর্ন অফ আফ্রিকা। ২০০৫ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়কালে হর্ন অফ আফ্রিকার দস্যুরা কি পরিমান অর্থ আদায় করেছে তার একটি আনুমানিক হিসাব করেছে বিশ্ব ব্যাংক।

 

সেই হিসাব অনুযায়ী জলদস্যুরা ক্রুদের জিম্মি করে সাড়ে তিনশ থেকে সোয়া চারশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ আদায় করেছে। এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে নাইজেরিয়ার ফেডারেল ইউনিভার্সিটির লেকচারার স্যামুয়েল ওয়েওল। তিনি বলেন,”ছিনতাইয়ের পেছনে মূল লক্ষ্য মুক্তিপণ আদায় বলেই ধারণা করা যায় “। অন্তত সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর নেপথ্য এটাই মূল কারণ। ২০১১ সালে একটি তেলের ট্যাঙ্কার জব্দ করে দস্যুরা। ২০০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের জ্বালানি ছিল নৌজানটিতে। আটক ২ ফিলিপিনো ক্রুকে হত্যা করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বহুজাতিক নৌ বাহিনীর তৎপরতায় দসুদের প্রতিহত করা সম্ভব হয় বলে দাবি স্যামুয়েল ওয়েওলের।

 

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংস্থা Oceans Beyond Piracy (OBP) প্রতিবেদন বলছে সাগরে দস্যুতার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৭ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে আইওসি তার বিবৃতিতে পরিস্থিতিকে উদ্বেগ জনক বলে জানিয়েছে। জাতিসংঘের অ্যান্টি পাইরেসি গ্রুপকে অতিসত্বর জরুরী বৈঠকে বসার আহ্বানও জানিয়েছেন তারা। সাম্প্রতিক হামলাগুলো অন্তত ছয়টি জলদস্যুতা বলে দাবি করেছে আই ও সি। ইউরোপীয় নৌবাহিনী MV Ruin এর ইস্যুটিকে একটি টেস্ট কেস হিসেবে দেখছে। তাদের দাবি এই জাহাজটির ভবিষ্যৎ থেকে ইঙ্গিত মিলবে এই অঞ্চলে দস্যুতার পুনরুত্থান দেখা যাবে কিনা।
 
যদি এখান থেকে ভালো অর্থ আদায় করতে পারে মৌসুম জুড়ে নৌ ডাকাতি একটা লাভজনক পেশা হিসেবে আকৃষ্ট করতে পারে তাদের। আর চলতি মার্চে বাংলাদেশী মালিকানাধীন জাহাজ আক্রমণ ক্রমবর্ধমান দস্যুবৃত্তির ইঙ্গিত দেয় বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। তবে সেই সংজ্ঞা অনুসারে গভীর সমুদ্রে জলদস্যুতা হয় অর্থাৎ যে জলসীমা কোন দেশের এক্তিয়ারের বাইরে EUNAV FOR ATALANTA তথ্য বলছে সাম্প্রতিক ছিনতাই এর অর্ধেক সোমালিয়ার আঞ্চলিক জলসীমায় ঘটেছে এর অন্য বিপদও আছে। সোমালিয়া থেকে দূরে হওয়ার কারণে যে কোন আক্রমণি জলদস্যুতা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে হুতি আক্রমণ প্রতিহত করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নৌ বাহিনীর এই অঞ্চলেও উপস্থিতি বাড়ানো প্রয়োজন যেন জলদস্যুতার পুনরুত্থান না ঘটে।
 
এদিকে জাহাজের মালিকদের লুকআউট বা দ্রুত গতিতে ভ্রমণের মতো পরামর্শ দিয়ে থাকে International Maritime Bureau (IMB) যাতে জলদস্যুরা তাদের ধরতে না পারে। প্রায়শই রাতের অন্ধকারে হাজির হয় তারা তাই ক্রুদের ঘটনা বুঝে উঠতেই দেরি হয়ে যায়। একবার জলদস্যুরা কোন জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে কারণ তাতে জিম্মিদের হতাহত হওয়ার সংকা বাড়ে। এদিকে সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে বলে দাবি করেছে EUNAV FOR ATALANTA। তাদের ভাষ্যমতে ওই এলাকায় নিয়োজিত অন্যান্য বাহিনীর সাথে যৌথ প্রচেষ্টায় দস্যুবৃত্তি পুনরায় ব্যাপকভাবে ফিরে আসা ঠেকাতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

 

তবে ইউরোপিয়ান নৌ বাহিনীর পাশাপাশি ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর সামরিক উপস্থিতি অনেক দস্যুতার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে। কিন্তু আইওসি এর অভিযোগ EUNAV বর্তমানে স্প্যানিশ নৌবাহিনীর একটি জাহাজ দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ভারতীয় নৌবাহিনী ছাড়া জলদস্যুতা প্রতিরোধে সক্রিয় থাকা অন্য বাহিনী গুলোর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা হয়েছে সমুদ্র জুড়ে। সোমালিয়ার হামলা মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কে দুটি ভু-রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে নজর দিতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা। তাই পরিস্থিতির অবনতি হলে জলদস্যুতা মোকাবেলা করা দেশগুলোর জন্য কঠিন হবে বলেও ধারণা বিশ্লেষকদের।

Leave a Comment