তবে কয়েক বছর ধরে দৌড়াতে অতিষ্ঠ হয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো এই রুটে তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়ায় এর ফলে ২০১২ সাল নাগাদ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসে দশ্যবৃত্তি। কিন্তু গত কয়েক মাসে সোমালিয়া জলদস্যুদের তৎপরতা বেড়েছে। পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে কাজ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌ বাহিনী তাদের মতে গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে সোমালিয়া উপকূলে অন্তত 14 টি জাহাজ হাইজ্যাক করা হয়েছে এর মধ্যে ইরানের পতাকা বাহি একটি মাছ ধরার নৌকা এবং লাইবেরিয়ার পতাকা বাহি Central Park নামের একটি জাহাজের জেলে ও নাবিকদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। Central Park এর উদ্ধার তৎপরতায় মার্কিন নৌবাহিনী জড়িত ছিল। পরে তারা জানায় এটা স্পষ্টতই দস্যুতা এবং আক্রমণকারীরা সম্ভবত সোমালিয়া ছিল। ডিসেম্বরে MV Ruin নামে মাল্টার পতাকাবাহী একটি জাহাজ হাইজ্যাক করা হয়। এখনো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ হামলাকারীদের হাতে। জিম্মি আছেন ১৭ জন ক্রু।
International Maritime Bureau (IMB) এর মতে এটি ছিল ৬ বছরের মধ্যে সোমালিয়ার প্রথম সফল হাইজ্যাকিং। তবে গত জানুয়ারিতে ভারতীয় নৌবাহিনী ব্যাপক অভিযান চালায়। এক সপ্তাহের তিনটি অভিযানে ১৯ জন জিম্মিকে মুক্ত করতে সমর্থ হয় তারা। তাদের মধ্যে ১১ জন ইরানের নাগরিক বাকিরা পাকিস্তানি। ভারতীয় বাহিনীর তরফে জানানো হয় এদের সবাই সোমালি দস্যুদের হাতে বন্দি ছিলেন।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি রিয়ালিটি চেক টিমের প্রতিবেদন বলছে, শুধু ২০১৮ সালে পূর্ব আফ্রিকান জলসীমায় ১১২ টি নৌ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। যার সর্বশেষ শিকার বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের দিকে যাওয়ার পথে মঙ্গলবার ২৩ জন ক্রু সহ জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয় জলদস্যুরা।
হুথিদের ঠেকাতে গিয়ে অরক্ষিত সোমালিয়া উপকূল দস্যুরা স্বভাবতই সুযোগ সন্ধানী। তারা নিরাপত্তা বাহিনীকে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করে নানাভাবে। এবার পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতিকে কাজে লাগাচ্ছে তারা। এমনটাই জানিয়েছে রয়্যাল ডেনিস ডিফেন্স কলেজের সহযোগি অধ্যাপক ট্রোয়েলস বুরচাল হেনিংসেন তার দাবি ২০০৫ থেকে ২০১২ সালে জলদস্যুতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। তখন আন্তর্জাতিক বাহিনী ওই জলসীমায় টহল জোরদার করে।
কিন্তু সম্প্রতি লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী বেশ কিছু জাহাজ আক্রমণ করায় সেদিকে বেশি নজর দিতে হয়েছে পশ্চিমা বাহিনীগুলোকে। সামরিক দিক থেকে দেখলে হুথিদের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের আক্রমণ মোকাবেলা করাটা বেশি জরুরি। তাই ড্রোন ক্ষেপণাস্ত্র সামাল দিতে গিয়ে জলদস্যুদের দিকে নজর দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন পশ্চিমা সামরিক বাহিনী।
এছাড়া পূর্ব আফ্রিকার জলসীমায় সেশেলস এবং কোমোরোস এর মতো দেশগুলোর একটি আঞ্চলিক সংস্থা আইওসি। গেল সপ্তাহে এক বিবৃতিতে হাইজ্যাকিং বেড়ে যাওয়ার পেছনে আরও কিছু কারনও উল্লেখ করেছে আইওসি। প্রায় দেড় দশক আগে প্রথম দফায় জেলেরা যে দস্যুতায় জরিয়ে পরেছিল তার অন্যতম কারণ বিদেশি ট্রলার এসে তাদের এলাকায় অবৈধভাবে মাছ ধরত ফলে স্থানীয় জেলেরা জীবিকার তাগিদে ডাকাতিকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য হয়।
আইওসি বলছে বর্তমান সোমালি মৎসনীতির কারনে আবারও বিদেশী মাছ ধরা জাহাজের উপস্থিতি বাড়ছে। এতে আবার উপকূলীয় সোমালিয়া জলদস্যুতার পথে পা বাড়াবে এমন সতর্কতা জানিয়েছে সংস্থাটি। সোমালিয়া ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠি আল শাবাব ডাকাতি আর অপহরণে উস্কানি দিচ্ছে এমন প্রসঙ্গও উঠে আসে আইওসির বিবৃতিতে।
একটি কথিত সমঝোতার ব্যাপারে শোনা যায়, যার বদৌলতে দস্যুদের সুরক্ষা দেয় জঙ্গিরা বিনিময়ে আদায়কৃত মুক্তিপণের একটা ভাগ তারা পায়। মূলত ত্রিকোন আকৃতির ভৌগলিক মানচিত্রের কারণে পূর্ব আফ্রিকাকে বলা হয় হর্ন অফ আফ্রিকা। ২০০৫ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়কালে হর্ন অফ আফ্রিকার দস্যুরা কি পরিমান অর্থ আদায় করেছে তার একটি আনুমানিক হিসাব করেছে বিশ্ব ব্যাংক।
সেই হিসাব অনুযায়ী জলদস্যুরা ক্রুদের জিম্মি করে সাড়ে তিনশ থেকে সোয়া চারশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ আদায় করেছে। এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে নাইজেরিয়ার ফেডারেল ইউনিভার্সিটির লেকচারার স্যামুয়েল ওয়েওল। তিনি বলেন,”ছিনতাইয়ের পেছনে মূল লক্ষ্য মুক্তিপণ আদায় বলেই ধারণা করা যায় “। অন্তত সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর নেপথ্য এটাই মূল কারণ। ২০১১ সালে একটি তেলের ট্যাঙ্কার জব্দ করে দস্যুরা। ২০০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের জ্বালানি ছিল নৌজানটিতে। আটক ২ ফিলিপিনো ক্রুকে হত্যা করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বহুজাতিক নৌ বাহিনীর তৎপরতায় দসুদের প্রতিহত করা সম্ভব হয় বলে দাবি স্যামুয়েল ওয়েওলের।
তবে ইউরোপিয়ান নৌ বাহিনীর পাশাপাশি ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর সামরিক উপস্থিতি অনেক দস্যুতার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে। কিন্তু আইওসি এর অভিযোগ EUNAV বর্তমানে স্প্যানিশ নৌবাহিনীর একটি জাহাজ দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ভারতীয় নৌবাহিনী ছাড়া জলদস্যুতা প্রতিরোধে সক্রিয় থাকা অন্য বাহিনী গুলোর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা হয়েছে সমুদ্র জুড়ে। সোমালিয়ার হামলা মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কে দুটি ভু-রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে নজর দিতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা। তাই পরিস্থিতির অবনতি হলে জলদস্যুতা মোকাবেলা করা দেশগুলোর জন্য কঠিন হবে বলেও ধারণা বিশ্লেষকদের।