তটরেখার পাশে একাকী
আকাশে সন্ধ্যার নরম আলো নেমে আসছিল।
সমুদ্রের দিগন্ত লালচে হয়ে উঠেছিল, যেন কেউ রঙের তুলিতে নরম করে আকাশের কোণে আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে।
সাগরের নোনা বাতাস চুল উড়িয়ে দিচ্ছিল লুকাসের কপালের ওপর।
সে বসে ছিল ধুঁকতে থাকা পুরনো নৌকার ধারে, চোখের সামনে বিস্তীর্ণ নীল জলরাশি — আর মনে তার বাবার কণ্ঠস্বর ঘুরপাক খাচ্ছিল।
“সবচেয়ে সত্যি জিনিসগুলো সমুদ্রের তলায় লুকিয়ে থাকে, ছেলে,” বাবা বলতেন।
“তুমি যদি সত্যিই জানতে চাও, তবে ভয় না পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।”
লুকাসের গলা শুকিয়ে এল।
বাবার মৃত্যুর পাঁচ বছর হয়ে গেছে।
তবুও, এই সমুদ্রের কাছে এসে তার বুকের ভেতরটা এখনো ছিঁড়ে যায়।
কতদিন হয়ে গেলো সে এভাবে বসে, রোজ সূর্য ডোবার সময় এখানে এসে? কেউ গুনে দেখে না।
তার মনে হয়, সে নিজেও এক সময় এই বালুর ঢিবির অংশ হয়ে যাবে, ধীরে ধীরে — বাবার মতো হারিয়ে যাবে নীরবে।
পেছনে ছোট্ট উপসাগরের দিকে তাকিয়ে লুকাস গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
এই উপসাগরেই একদিন তার বাবা, ক্যাপ্টেন এলিয়াস, শেষবারের মতো যাত্রা করেছিলেন — এক পুরনো কারাভেল (পর্তুগিজদের দ্বারা তৈরি একটি ছোট পালতোলা জাহাজ) নিয়ে, আর কখনো ফিরে আসেননি।
সেই স্মৃতি এখন ধুলোমলিন হয়ে গেলেও, লুকাসের মনে তখনকার দিনগুলো উজ্জ্বল আগুনের মতো জ্বলছিল।
সেই সময়েই, তার কানে ভেসে এলো ধীরে ধীরে এগিয়ে আসা পায়ের শব্দ। জুতার গোড়ালি বালুর ওপর চাপা খটখট শব্দ তুলছিল।
লুকাস কপাল কুঁচকে সামনে তাকালো।
একজন অচেনা বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে ছিল।
তার পরনে ছিল এক ধরনের লম্বা কোট, মুখটা অর্ধেক ছায়ায় ঢাকা।
কাঁধে ছিল ছোট একটা চামড়ার ব্যাগ।
বৃদ্ধের চোখদুটো ছিল অদ্ভুত — যেন হাজার সমুদ্র পেরিয়ে আসা দুটো ক্লান্ত নীল তারা।
“তুমি ক্যাপ্টেন এলিয়াসের ছেলে?”
সোজা গলায় প্রশ্ন করলো বৃদ্ধ।
তার গলার স্বর ছিল নরম, কিন্তু ভিতরে যেন লুকিয়ে ছিল একগাদা বোঝা।
লুকাস কিছুটা অবাক হয়ে মাথা নাড়ল।
“হ্যাঁ,” বলল সে। “আপনি কে?”
বৃদ্ধ হাসলেন, যেন সেই হাসির ভেতরে দুঃখের ঢেউ আছড়ে পড়ছে।
“তোমার বাবার বন্ধু ছিলাম। বহুদিন আগে।”
তিনি ব্যাগ থেকে সাবধানে বের করলেন একটা মোটা চামড়ার মোড়ানো পুরনো নথি।
“এটা তোমার জন্য রেখে গিয়েছিলেন,” বললেন তিনি।
“তিনি বলেছিলেন, একদিন তুমি নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে — কোথায় যেতে হবে।”
লুকাস ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে কাগজটা হাতে নিলো।
চামড়ার গন্ধ আর পুরনো কালি মিশে একরকম অদ্ভুত পুরাতন সময়ের সুবাস ছড়াচ্ছিল।
তিনি যখন খুলে দেখল, তার চোখ ছলকে উঠল।
একটা মানচিত্র।
কিন্তু কোনো সাধারণ মানচিত্র নয়।
সমুদ্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চল চিত্রিত, বেশ কিছু অচেনা দ্বীপ আর অর্ধেক হারিয়ে যাওয়া পথরেখা — আর তার ঠিক মাঝখানে ছোট অক্ষরে লেখা:
“লাস্ট কারাভেল”।
লুকাসের বুকের ভেতর বাজ পড়ার মতো একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল।
তার বাবা এই নামই বলতেন শেষবার যখন কথা হয়েছিল — সেই রহস্যময় শেষ যাত্রার কথা, যেখানে এক ‘হারানো’ সত্য খুঁজে পেতে গিয়েছিলেন।
“কিন্তু… এখন কেন?”
লুকাস কাঁপা গলায় জানতে চাইল।
বৃদ্ধ গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে।
“কারণ সময় শেষ হয়ে আসছে,” বললেন তিনি।
“অনেকেই এখনো ওই সত্যের খোঁজে আছে। তবে সবাই ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে নয়।”
এক মুহূর্ত থেমে তিনি নিচু গলায় যোগ করলেন,
“যদি তুমি বাবার উত্তরাধিকার নিতে চাও — এখনই তোমার যাত্রা শুরু করতে হবে। কাল সকালে, এর আগে নয়।” সমুদ্রের বাতাস এক ঝটকায় আরও ঠান্ডা হয়ে এলো। দিগন্তে, সূর্য সম্পূর্ণ ডুবে যাচ্ছিল।
আকাশের লাল আভা মুছে গিয়ে অন্ধকারের প্রথম ছায়া পড়ছিল জলরাশির ওপর। লুকাসের মনে হলো, সমুদ্রের ঢেউ এখন আর শুধু বাতাসে কথা বলছে না — বরং তার নাম ধরে ডাকছে, চেপে চেপে।
হাতে শক্ত করে চেপে ধরা মানচিত্রটা বুকের কাছে টেনে নিলো সে। তার ভেতর এক অদ্ভুত তৃষ্ণা জাগছিল — ভয় আর উত্তেজনার মিশ্র অনুভূতি।
একটা নতুন যাত্রার শুরু হয়ে গেছে।
পিছনে ফেরার আর কোনো রাস্তা নেই।
আর তখনই…
হঠাৎই দূরে সমুদ্রের বুক থেকে একটা অদ্ভুত নীল আলো উঠতে দেখল লুকাস। জলের ঢেউয়ের ফাঁক দিয়ে একটা ক্ষীণ আলোকছটা আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছিল — যেন সমুদ্র নিজে কোনো গোপন বার্তা পাঠাচ্ছে তাকে।
লুকাস দাঁড়িয়ে গেল।
হাওয়ার ঝাপটায় মানচিত্রের কাগজ ফড়ফড়িয়ে উঠল — আর সেই অদ্ভুত আলো তাকে ডাকতে থাকল…
[চলবে…]
দ্বিতীয় পর্ব: পুরাতন কারাভেলের গল্প