এইচএমপিভি ভাইরাস কি করোনার মতো মহামারী আকার ধারন করবে? এর লক্ষন ও প্রতিকার সম্পর্কে জানুন

চীনে HMPV ভাইরাসের সংক্রমণকে ঘিরে সারা বিশ্বে আতঙ্কে রয়েছে। হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) নামের এই ভাইরাসের খোঁজ চীনের মতো প্রতিবেশী জাপানেরও কিছু অঞ্চলে পাওয়া গেছে। গত সোমবার ভারতেও এই ভাইরাসে আক্রান্ত তিনজনকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।

এইচএমপিভি কেমন ভাইরাস?

এই ভাইরাস মানবদেহের জন্য কতটা বিপজ্জনক?

এইচএমপিভি ভাইরাসেও কি করোনার মতো মহামারি বা অতিমারি হওয়ার সম্ভাবনা আছে?

এইচএমপিভি কি

হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) হলো এমন এক ধরনের ভাইরাস, যা মানুষের শ্বাসনালিকে আক্রান্ত করে। এটি বায়ুবাহিত ভাইরাস, যা প্রথম ২০০১ সালে নেদারল্যান্ডসে শনাক্ত করা হয়। এই ভাইরাস পরিবেশে থাকা ধূলিকণা, আক্রান্ত ব্যক্তি বা জড় বস্তুর সংস্পর্শ থেকে শরীরে প্রবেশ করে। হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে এটি একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রথমদিকে এই ভাইরাসের লক্ষণগুলো সাধারণ সর্দি-কাশি বা জ্বরের মতোই দেখা যায়। ফলে অনেকেই একে গুরুত্ব দেন না। সাধারণত শীতের শেষ এবং বসন্তের শুরুতে এইচএমপিভি বেশি সক্রিয় থাকে। এটি যে কোনো বয়সের মানুষের মাঝে ছড়ালেও শিশু এবং বয়স্কদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

বর্তমানে এটি শ্বাসজনিত রোগের অন্যতম ভয়াবহ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে চীনের সাম্প্রতিক প্রাদুর্ভাবের পর উত্তর এশিয়ার জন্য এটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। এই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং জনসমাগমে সতর্ক থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এইচএমপিভি সংক্রমণের কারণ ও লক্ষণ

এইচএমপিভি (হিউম্যান মেটাপনিউমোভাইরাস) একটি বায়ুবাহিত ভাইরাস যা মূলত মানুষের শ্বাসনালিতে আক্রমণ করে। এটি সংক্রমণের জন্য বিভিন্ন পরিস্থিতি ব্যবহার করে এবং পোষক দেহে প্রবেশের মাধ্যমে জটিল শ্বাসজনিত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

সংক্রমণের কারণ

এই ভাইরাস সংক্রমণের কারণ হতে পারে:

  • বায়ুবাহিত কণা বা ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়ানো।
  • বয়স, স্বাস্থ্যের অবস্থা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
  • শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি, বা দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি।

লক্ষণসমূহ

এইচএমপিভি সংক্রমণের লক্ষণ ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে হালকা থেকে গুরুতর হতে পারে।

হালকা লক্ষণ

  1. সর্দি বা নাক বন্ধ।
  2. কাশি এবং গলা ব্যথা।
  3. হালকা জ্বর।
  4. ক্লান্তি।

গুরুতর লক্ষণ

যেসব ক্ষেত্রে সংক্রমণ গুরুতর হয়, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে, লক্ষণগুলো হলো:

  1. শ্বাসকষ্ট।
  2. বুক ব্যথা।
  3. অবিরাম কাশি।
  4. সেকেন্ডারি ইনফেকশন, যা ব্রঙ্কিওলাইটিস বা নিউমোনিয়ার দিকে গড়াতে পারে।

 

এইচএমপিভি প্রতিরোধের উপায়

  1. হাত ধোয়া:
    • নিয়মিত সাবান ও পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুতে হবে।
    • বাইরে থেকে আসার পর, খাবার খাওয়ার আগে এবং শিশুদের স্পর্শ করার আগে হাত ধোয়া নিশ্চিত করুন।
  2. মুখ ঢেকে রাখা:
    • কাশি বা হাঁচির সময় মুখ ঢাকার জন্য টিস্যু বা কনুই ব্যবহার করুন।
    • ব্যবহৃত টিস্যু তাৎক্ষণিকভাবে ফেলে দিন।
  3. জিনিসপত্র পরিষ্কার রাখা:
    • নিয়মিত ব্যবহৃত মোবাইল, টেবিল, দরজার হাতল এবং অন্যান্য জিনিসপত্র জীবাণুমুক্ত করুন।
  4. দূরত্ব বজায় রাখা:
    • অসুস্থ ব্যক্তিদের কাছ থেকে কমপক্ষে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন।
    • ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে যেতে হলে মাস্ক ব্যবহার করুন।

স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন

  1. টিকা গ্রহণ:
    • বর্তমানে এইচএমপিভির জন্য কোনো নির্দিষ্ট টিকা নেই, তবে নিয়মিত অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রজনিত টিকা গ্রহণ করুন।
  2. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস:
    • ভিটামিন সি এবং জিঙ্কসমৃদ্ধ খাবার বেশি খান। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।
  3. পর্যাপ্ত বিশ্রাম:
    • প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন।
  4. ব্যায়াম:
    • নিয়মিত ব্যায়াম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে।

জীবনযাত্রায় পরিবর্তন

  1. ধূমপান পরিহার করুন:
    • ধূমপান ফুসফুসের স্বাস্থ্য নষ্ট করে এবং শ্বাসযন্ত্রজনিত রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
  2. পর্যাপ্ত হাইড্রেশন:
    • প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করুন। এটি শরীরকে ডিটক্সিফাই করে।
  3. বাড়ি পরিষ্কার রাখুন:
    • ঘরের বায়ু প্রবাহ ভালো রাখার জন্য নিয়মিত জানালা খুলুন এবং ঘর জীবাণুমুক্ত রাখুন।
  4. মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন:
    • স্ট্রেস কমানোর জন্য মেডিটেশন বা রিল্যাক্সেশনের চর্চা করুন।

এই নিয়মগুলো মেনে চললে আপনি এইচএমপিভি থেকে নিজেকে এবং আপনার পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষিত রাখতে পারবেন।

এইচএমপিভি ভ্যাকসিন ও চিকিৎসা

ভ্যাকসিন সম্পর্কে

এইচএমপিভি-র জন্য বর্তমানে কোনো অনুমোদিত ভ্যাকসিন নেই। যদিও কিছু ভ্যাকসিন গবেষণা পর্যায়ে রয়েছে, যেমন মডার্নার একটি পরীক্ষামূলক এমআরএনএ ভিত্তিক ভ্যাকসিন। গবেষকরা ভাইরাসটির ফিউশন (F) প্রোটিনকে লক্ষ্য করে কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছেন, যা ভাইরাস সংক্রমণের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। তবে আরএসভি (Respiratory Syncytial Virus)-এর ক্ষেত্রে সফল মডেলগুলো এইচএমপিভি ভ্যাকসিন তৈরির জন্য সহায়ক হতে পারে।

চিকিৎসা পদ্ধতি

এইচএমপিভি নির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হলো উপসর্গগুলো নিয়ন্ত্রণ করা এবং জটিলতা প্রতিরোধ করা।

  • মৃদু উপসর্গের জন্য: বিশ্রাম, পর্যাপ্ত পানি পান, এবং জ্বর বা ব্যথার জন্য সাধারণ ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • গুরুতর ক্ষেত্রে: অক্সিজেন থেরাপি বা হাসপাতালে ভর্তি প্রয়োজন হতে পারে।
  • জটিল রোগীদের জন্য: রিবাভিরিন এবং ইমিউনোগ্লোবুলিন (IVIG)-এর মতো থেরাপি ব্যবহৃত হয়।

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

  • নিয়মিত হাত ধোয়া।
  • অসুস্থ ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়ানো।
  • শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে জীবাণুমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখা।

এইচএমপিভি আক্রান্ত হলে সাধারণত ৭-১০ দিনের মধ্যে সেরে ওঠা সম্ভব, তবে গুরুতর রোগীদের চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা উচিত। নতুন ওষুধ এবং ভ্যাকসিনের উন্নয়নে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে।

উৎস: CDC, Cleveland Clinic, এবং Wikipedia থেকে সংগৃহীত তথ্য।

Leave a Comment