প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের দিনে পান্তা ভাত নিয়ে আলোচনা হলেও এই খাবারটি নিয়ে এবার আলোচনা করা হয়েছে ভিন্ন এক কারনে। দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় যেসব অঞ্চলে প্রচুর ধান উৎপন্ন হয় এবং যেসব দেশে ভাত প্রধান খাবার, মূলত সেসব দেশে ভাত পানিতে ভিজিয়ে খাওয়ার পদ্ধতি চালু আছে। এসব এলাকায় আবহাওয়া খুব বেশি গরম ও আদ্র হওয়ার কারনে খুব সহজেই ভাত নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু পানিতে ভিজিয়ে রাখার জন্য ভাত দ্রুত নষ্ট হয় না।
মূলত সংরক্ষণের কথা বিবেচনা করেই পান্তা ভাতের চল শুরু হয়।
পান্তা ভাত কিভাবে হয়
সাধারণত আগের দিন রাতের রান্না করা ভাত বেচেঁ গেলে সংরক্ষনের জন্য এই ভাতকে নির্দিষ্ট পরিমান জল দিয়ে প্রায় এক রাত ডুবিয়ে রাখলেই তা পান্তায় পরিণত হয়। এভাবে দশ বারো ঘন্টা ধরে সারা রাত রেখে দেওয়ার ফলে পানি ও ভাতের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়। এসময় পানির নিচে থাকা ভাত বাতাসের অর্থাৎ অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসতে পারে না। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পানির কারনে ভাতের এই ফারমেন্টেশন বা গাজন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় এবং পাত্রের ভিতরে এনারোবিক ফারমেন্টেশনের ঘটনা ঘটে।
গবেষণায় দেখা গেছে, পান্তা ভাতে নানা ধরনের মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা পুষ্টিকর খনিজ পদার্থ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, জিংক, ফসফরাস, ভিটামিন বি ইত্যাদি। সাধারণ ভাতের তুলনায় পান্তা ভাতে এসব পুষ্টিদায়ক পদার্থের পরিমান অনেক বেশি থাকে। ১০০ মিলিগ্রাম সাধারণ ভাতে আয়রনের পরিমান থাকে ৩.৫ মিলিগ্রাম। কিন্তু ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে তৈরি পান্তা ভাতে এর পরিমান বেড়ে গিয়ে হয় ৭৩.৯ মিলিগ্রাম। একইভাবে ক্যালসিয়ামের পরিমানও অনেক বেড়ে যায়। ১০০ মিলিগ্রাম সাধারণ ভাতে যেখানে ক্যালসিয়াম থাকে ২১ মিলিগ্রাম, সেখানে পান্তা ভাতে এর পরিমাণ দাড়ায় ৮৫০ মিলিগ্রাম। গবেষণায় দেখা গেছে পান্তা ভাতে পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও জিংকের উপস্থিতিও অনেক বেড়ে যায়।
উপকারিতা
১) পান্তা ভাতে থাকা পুষ্টিকর পদার্থগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটিকে শক্তিশালী করে।
২) পান্তা ভাতে প্রচুর পরিমানে আয়রণ পাওয়া যায় যেটা দেহের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।
৩) শরীরে হাড়গুলোকে শক্ত রাখে ক্যালসিয়াম। শরীরে নিঃসৃত এনজাইমকে সক্রিয় করতে সাহায্য করে ম্যাগনেসিয়াম।
৪) পান্তা ভাতে প্রচুর পরিমানে বিটা-সিটোস্টেরল, কেম্পেস্টেরোলের মতো মেটাবলাইটস রয়েছে য শরীরকে প্রদাহ বা যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করে। এসব কোলেস্টোরেল কমাতেও সাহায্য করে।
৫) পান্তা ভাতে আইসোরহ্যামনেটিন-সেভেন-গ্লুকোসাইড ফ্ল্যাভোনয়েডের মতো মেটাবলাইটস রয়েছে যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
৬) পান্তা ভাতে ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া রয়েছে যা স্বাস্থের জন্য উপকারী। সাধারণত দই এর মধ্যে এই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়।
৭) এছাড়া গরমের সময় পান্তা ভাত শরীরকে ঠান্ডা রাখে।
অপকারিতা
১) ১২ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে ভাতের ফারমেন্টেশন হলে সেখানে অ্যালকোহলের উপাদান তৈরী হয় এবং সেই পান্তা ভাত খাওয়ার পর শরীর ম্যাজ ম্যাজ করে এবং ঘুম পেতে পারে।
২) পান্তা ভাত যদি পরিষ্কার পাত্রে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে তৈরী করা না হয় তাহলে সেখানে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া তৈরী হতে পারে। সেই ভাত খেলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বে।
৩) বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, উড়িষ্যা, দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ এসব অঞ্চলেও পান্তা ভাত জনপ্রিয় খাবার। তবে একেক জায়গায় পান্তা ভাতকে একেক নামে ডাকা হয়।
৪) চীন, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়াতেও ফার্মেন্টেড রাইস খাওয়া হয় তবে সেটা তৈরী করার প্রক্রিয়া ও স্বাদ পান্তা ভাতের চেয়ে আলাদা।