দ্য লাস্ট কারাভেল পর্ব-২

পুরাতন কারাভেলের গল্প

সারারাত ঘুমাতে পারেনি লুকাস।
মানচিত্রের প্রতিটি রেখা, প্রতিটি দাগ তার চোখের পাতায় জ্বলজ্বল করছিল। বাবার কথা, সেই পুরনো গল্পগুলো — সব যেন এক ভয়ংকর ঢেউ হয়ে মাথার ভেতর গর্জন করছিল।

সূর্য ওঠার আগেই সে প্রস্তুত হয়ে গেল।
পুরনো ব্যাগে কয়েকটা শুকনো খাবার, একটা ছেঁড়া নোটবুক আর বাবার দেওয়া পকেট কম্পাস ভরে নিলো।
সমুদ্রের বাতাস কেমন অদ্ভুত ঠান্ডা লাগছিল আজ — যেন শীতল কোনো আগমনের ইঙ্গিত।

বৃদ্ধ, যার নাম সে এখনো জানে না, তাকে উপসাগরের পুরনো পাথরের ঘাটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে দেখলো।
তার মুখে ছিল না কোনো হাসি, ছিল না কোনো উষ্ণতা — যেন তিনি জানতেন সামনে কী ভয়ঙ্কর সময় অপেক্ষা করছে।

“চলো,” শুধু এটুকুই বললেন তিনি।
“আজ তোমাকে কিছু দেখতে হবে।”

লুকাস কিছু না বলেই তার পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো।
পথে কোনো কথা হলো না। শুধু সমুদ্রের গর্জন আর পায়ের নিচে বালির চাপা শব্দ।

ঘাট থেকে কিছুদূরে, ঝোপের আড়ালে লুকানো ছিল একটি পরিত্যক্ত ছোট্ট নৌকা। বৃদ্ধ সেটা ঠেলে পানিতে নামাতে সাহায্য করতে বললেন।
লুকাস একটু দ্বিধায় পড়লেও এগিয়ে গেল।

নৌকা ভাসতে শুরু করতেই বৃদ্ধ বললেন,
“তুমি এখনো জানো না তোমার বাবার শেষ যাত্রা কোথায় ছিল।” তার গলা হালকা কাঁপছিল — যেন স্মৃতির ভারে গলা আটকে আসছিল।

“তিনি একটি বিশেষ জাহাজ খুঁজছিলেন,” বললেন বৃদ্ধ।
“একটা হারিয়ে যাওয়া কারাভেল — শেষ এক কারাভেল, যেটা আজও সমুদ্রের বুকের কোথাও ঘুমিয়ে আছে।
কারাভেলটা কোনো সাধারণ জাহাজ ছিল না, লুকাস। এটা ছিল একটা প্রতীক — হারানো সত্য, মানুষের লোভ আর সাহসের সাক্ষী।”

লুকাস দৃষ্টি সরাল না সমুদ্রের দিক থেকে।
“তুমি কি জানো, সেই কারাভেল এখন কোথায়?”

বৃদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“জানি না। কিন্তু আমরা কাছাকাছি আছি।”
তিনি নৌকার তলা থেকে বের করলেন আরেকটা পুরনো মানচিত্র — বাবার মানচিত্রেরই একটা টুকরো অংশ!

“তোমার বাবা এই মানচিত্রটা খুঁজে পেয়েছিলেন শেষ যাত্রার আগে। সে বুঝতে পেরেছিল, সব পথ একদিন এই উপসাগরের দিকে ফিরে আসবে।”

নৌকা এবার সমুদ্রের একটু গভীরে চলে এলো।
দিগন্তের একপাশে দেখা যাচ্ছিল ভাঙ্গাচোরা একটা পুরনো কাঠের পিলার — সম্ভবত এক সময় কোনো বন্দরের অংশ ছিল।
পিলারের মাথায় একটা ধূসর পাখি বসে ছিল, যেন সেই নিঃসঙ্গ স্তম্ভের একমাত্র পাহারাদার।

“তুমি ভয় পাচ্ছ?” হঠাৎ প্রশ্ন করলো বৃদ্ধ।
তার কণ্ঠে কোনো তাচ্ছিল্য ছিল না, বরং একধরনের গোপন উদ্বেগ।

লুকাস কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
“ভয়? হ্যাঁ। কিন্তু আমি থামবো না।”

বৃদ্ধের চোখে যেন এক মুহূর্তের জন্য একটু গর্বের ঝিলিক দেখা গেল। তিনি মাথা নত করে বললেন,
“তোমার বাবাও এমনই ছিল। ঠিক তোমার মতো।”

নৌকা এবার একটা নির্জন ছোট দ্বীপের কাছাকাছি চলে এলো। দ্বীপটা প্রায় অর্ধেক ডুবে ছিল, বালু আর শেওলায় ঢাকা। কিছু ভাঙা কাঠামো দেখা যাচ্ছিল — মনে হচ্ছিল এগুলো কোনো জাহাজের ভগ্নাংশ হতে পারে।

“ওখানে দেখো,” বৃদ্ধ আঙুল তুললেন।
“ওখানেই প্রথম সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল ‘লাস্ট কারাভেলের’ চিহ্ন।”

লুকাস নৌকা ঠেলে দ্বীপের কাদামাখা পাড়ে নামল।
পায়ে শেওলা আর কর্দম আটকে যাচ্ছিল।
তবুও এগিয়ে গেল — কিছু একটা তাকে টানছিল।

ভাঙা কাঠের গাদার মধ্যে সে দেখতে পেল একটা পুরনো ধাতব পিন, যার ওপর অদ্ভুত কোনো প্রতীক খোদাই করা — দুই ক্রস করা তরবারি আর তার মাঝখানে ছোট্ট একটি তারা।

সে হাত বাড়িয়ে ধরতেই আচমকা একটা ঠান্ডা শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো শরীরজুড়ে। কেমন একটা অদ্ভুত, ভয়ংকর কাঁপুনি লাগলো লুকাসের গায়ে।

পেছন ফিরে দেখলো, বৃদ্ধ দূর থেকে তাকিয়ে আছে।
তার চোখে গভীর সতর্কতার আভাস। হয়তো তিনিও অনুভব করছেন — এই দ্বীপ আর এই প্রতীক, কেবল ভাঙা কাঠের টুকরো নয়, বরং বহু পুরনো অভিশাপের চিহ্ন।

সমুদ্রের দিক থেকে আবার সেই অদ্ভুত নীল আলো ভেসে উঠলো — ঠিক যেখানে দিগন্ত আর জল মিশে গেছে।

লুকাসের মনে হলো, কোনো এক হারানো কণ্ঠ ডাকছে তাকে। কান পেতে সে শুনতে পেল মৃদু ফিসফিস শব্দ —
“লুকাস… ফিরে এসো… এখনো সময় আছে…”

কিন্তু সে জানতো, এখন আর পেছনে ফেরা সম্ভব নয়।

সামনে যে রহস্য অপেক্ষা করছে, সেটা হয়তো তার জীবনটাই বদলে দেবে… বা হয়তো কেড়ে নেবে চিরতরের মতো।

[চলবে…]

তৃতীয় পর্ব: হারানো ছায়ার সংকেত

Leave a Comment